এক নজরে সভ্যতা
![]() |
facts in shorts of harappa civilization,Indus Valley Civilisation in bengali |
আবিষ্কার: বিশ শতকের সূচনায় সিন্ধু নদের অববাহিকায় খননকার্য চালিয়ে আর্য - পূর্ব যুগের এক উন্নত সভ্যতা আবিষ্কৃত হয়েছে । এর ফলে প্রমাণিত হয়েছে যে , খ্রিস্ট - জন্মের প্রায় তিন হাজার বছর আগে ভারতে এক উন্নত নগর সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল এবং এই সভ্যতা মিশর , সুমের , ব্যাবিলন ও আক্কাদের সভ্যতার সমসাময়িক । ১৯২১ খ্রিস্টাব্দে দয়ারাম সাহানি পাঞ্জাবের মন্টগোমারি জেলায় ইরাবতী বা রাভি নদীর তীরে এক উন্নত নগর সভ্যতার সন্ধান পান । ঠিক এই একই সময়ে ১৯২২ খ্রিস্টাব্দে বিশিষ্ট বাঙালি প্রত্নতত্ত্ববিদ রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় সিন্ধু নদের পশ্চিম তীরে সিন্ধুপ্রদেশের লারকানা জেলায় ‘ মহেঞ্জোদারো ’ ( সিন্ধি শব্দ , অর্থ ‘ মৃতের স্তূপ ’ ) নামক স্থানে এক উন্নত সভ্যতা আবিষ্কার করেন । এই আবিষ্কারের সঙ্গে স্যার জন মার্শাল , স্যার মর্টিমার হুইলার , ম্যাকে , পিগট , ফ্রাঙ্কফোর্ট , রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায় , দয়ারাম সাহানি , ননীগোপাল মজুমদার প্রমুখ প্রত্নতত্ত্ববিদের নাম জড়িয়ে আছে ।সিন্ধু নদের তীরে প্রথম এই সভ্যতা আবিষ্কৃত হয় বলে আগে এই সভ্যতাকে ‘ সিন্ধু সভ্যতা ’ বলা হত । সাম্প্রতিককালে সিন্ধুতট অতিক্রম করে ভারত ও ভারতের বাইরে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে ছোটো - বড়ো মিলিয়ে এই সভ্যতার প্রায় ১৫০০ টি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে । এ কারণে এখন আর সিন্ধু সভ্যতা না বলে প্রথম
১ ) সমসাময়িক যুগে মিশর বা মেসোপটেমিয়াতে যে সভ্যতার উন্মেষ হয়েছিল প্যাপিরাস , পোড়ামাটি পাথরের বুকে তার লিখিত বিবরণ পাওয়া যায় । পণ্ডিতরা সেগুলি পাঠ করে তার ইতিহাস রচনা করেছেন । সিন্ধু উপত্যকার সিলমোহর ও বিভিন্ন পাত্রের গায়ে বেশ কিছু লিপি খোদাই করা আছে । সেগুলির পাঠোদ্ধার করা সম্ভব হয় নি । পণ্ডিতরা তাই বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন , যথা — ঘরবাড়ির ধ্বংসাবশেষ , বাসনপত্র , অস্ত্রশস্ত্র এবং মানুষ , পশুপক্ষী ও দেবদেবীর মূর্তির উপর ভিত্তি করে হরপ্পা সভ্যতার বিবরণ লিপিবদ্ধ করেন । এই কারণে এই সভ্যতাকে প্রাগৈতিহাসিক সভ্যতা বলা হয় ।
( ২ ) এই যুগে মানুষ লোহার ব্যবহার জানত না । এ সময় পাথরের ব্যবহার কমে আসতে থাকে এবং ব্রোঞ্জ ও তামার ব্যবহার বৃদ্ধি পায় । পাথরের হাতিয়ার ও সরঞ্জামের পাশাপাশি ব্রোঞ্জ ও তামার ব্যবহারও চলতে থাকে । তাই এই সভ্যতা হল তাম্র - প্রস্তর যুগের সভ্যতা ।
( ৩ ) সুমের , আক্কাদ , ব্যাবিলন ও মিশর প্রভৃতি বিশ্বের প্রাচীনতম সভ্যতাগুলির মতো হরপ্পা সভ্যতা ছিল নদীমাতৃক সভ্যতা ।
( ৪ ) সিন্ধুনদকে কেন্দ্র করে সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সভ্যতা গড়ে ওঠে । কেবলমাত্র সিন্ধু উপত্যকাই নয় ——সিন্ধুতট অতিক্রম করে পাঞ্জাব , বেলুচিস্তান
, রাজপুতানা , গুজরাট , সৌরাষ্ট্র এবং নর্মদা উপত্যকার এক বিস্তীর্ণ স্থানে এই সভ্যতা বিস্তৃত হয়েছিল । উত্তরে জন্ম থেকে দক্ষিণে নর্মদা উপত্যকা এবং পশ্চিমে বেলুচিস্তানের মাকরান মরু - উপকূল থেকে উত্তর - পূর্বে মিরাট পর্যন্ত এর ব্যাপ্তি ছিল । পুরো এলাকাটি ছিল একটি ত্রিভুজের মতো এবং এর আয়তন হল প্রায় ১২ লক্ষ ৫০ হাজার বর্গ কিলোমিটার । আয়তনের দিক থেকে এলাকাটি প্রাচীন মিশরের চেয়ে ২০ গুণ এবং যুগ্মভাবে মিশর ও মেসোপটেমিয়ার চেয়ে ১২ গুণ বড়ো । এটি হল প্রাচীন বিশ্বের বৃহত্তম সভ্যতা ।
( ৫ ) বর্তমানে হরপ্পা সভ্যতার প্রায় ১৪০০ টি কেন্দ্র আবিষ্কৃত হয়েছে এবং এগুলির মধ্যে বেশ কয়েকটি কেন্দ্র শহর নামের অধিকারী । নগর - কেন্দ্রগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হল হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারো । এই নগরী দুটির মধ্যে দূরত্ব প্রায় ৪৮৩ কিলোমিটার । এছাড়া চানহুদারো , কোটদিজি , রূপার , আলমগীরপুর , লোথাল , রংপুর , রোজদি , সুরকোটরা , কালিবঙ্গান , বানওয়ালি প্রভৃতি স্থানে উন্নত নগর জীবনের নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে
( ৬ ) প্রায় তেরো লক্ষ বর্গ কিলোমিটার বিস্তৃত এই এলাকাটিতে সর্বত্রই একই ধরনের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির চিহ্ন আবিষ্কৃত হয়েছে । এই সভ্যতার নগরীগুলির অবস্থানগত দূরত্ব যথেষ্ট , কিন্তু এ সত্ত্বেও নগরীগুলির পরিকল্পনা , গঠন - রীতি ও জীবনযাত্রার উপকরণে যথেষ্ট মিল আছে । সুতরাং একটি নগর সম্পর্কে আলোচনা করলেই অন্যান্য নগর সম্পর্কে মোটামুটি একটি ধারণা করা যায় । এখানে মহেঞ্জোদারো শহরটি সম্পর্কে আলোচনা করা যেতে পারে ।
মহেঞ্জোদারো শহরটির পশ্চিম দিকে প্রায় চল্লিশ ফুট উঁচু একটি বিশালায়তন ঢিপির উপর
( ১ ) একটি দুর্গ ছিল । এই দুর্গ অঞ্চলে কিছু ঘরবাড়িও আবিষ্কৃত হয়েছে । মনে হয় , সেগুলি শাসকদের বাসস্থান
( ৩ ) এরই পাশে ছিল একটি কেন্দ্রীয় শস্যাগার । এর আয়তন ছিল প্রায় ৯০০০ বর্গফুট । ডঃ এ . এল . ব্যাসাম এটিকে রাষ্ট্রীয় ব্যাঙ্কের সঙ্গে তুলনা করেছেন । স্যার মর্টিমার হুইলার বলেন যে , খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকের পূর্বে এ ধরনের বিশাল শস্যাগার পৃথিবীর আর কোথাও পাওয়া যায় নি ।
( ৪ ) এই অঞ্চলের অন্যান্য বড়ো বড়ো বাড়ির ধ্বংসাবশেষকে পণ্ডিতরা সভাকক্ষ , শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও সমিতি - গৃহ বলে চিহ্নিত করেছেন । দুর্গ অঞ্চলের এই দক্ষিণ এবং পূর্ব থেকে উঁচু ঢিপির পূর্বদিকে নিচু জমিতে মূল শহরটি গড়ে উঠেছে । নগরের উত্তর থেকে পশ্চিম দিকে সমান্তরালভাবে কয়েকটি রাস্তা চলে গেছে । রাস্তাগুলি ন’ফুট থেকে ত্রিশ ফুট পর্যন্ত চওড়া । এই রাস্তাগুলি থেকে বেরিয়ে এসেছে অসংখ্য গলি । গলিগুলির দু'পাশে নাগরিকদের ঘরবাড়ি । বাড়িগুলি পোড়া - ইটের তৈরি এবং অনেক বাড়িই দোতলা বা তিনতলা । প্রত্যেক বাড়িতে প্রশস্ত উঠোন , স্নানাগার , কুয়ো ও নর্দমার ব্যবস্থা ছিল । অনেক বাড়িতে আবার ‘ সোকপিট ’ ছিল । বাড়ির নোংরা জল নর্দমা দিয়ে এসে রাস্তার ঢাকা দেওয়া বাঁধানো নর্দমায় পড়ত । নর্দমাগুলি পরিষ্কারের জন্য ইট দিয়ে তৈরি ঢাকা ম্যানহোল ’ - এর ব্যবস্থা ছিল । ডঃ এ . এল . ব্যাসাম বলেন যে , রোমান সভ্যতার পূর্বে অপর কোনও প্রাচীন সভ্যতায় এত পরিণত পয়ঃপ্রণালী ব্যবস্থা ছিল না । প্রত্যেক বাড়ির সামনে বাঁধানো ‘ ডাস্টবিন ' ছিল ।কেবলমাত্র বড়ো রাস্তার উপরেই শহরের দোকানগুলি অবস্থিত ছিল । শহরের উত্তর - পূর্ব কোণে সারিবদ্ধভাবে ছোটো ছোটো কিছু খুপরি - জাতীয় ঘর ছিল । মনে হয় , এগুলি দরিদ্র ও শ্রমজীবী মানুষদের বাসস্থান । অধ্যাপক গর্ডন চাইল্ড বলেন যে , হরপ্পার পৌরশাসকরা গৃহ - নির্মাণ সংক্রান্ত আইন - কানুন মেনে চলতেন ।
খননকার্যের ফলে মহেঞ্জোদারোতে সভ্যতার ন’টি স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে , অর্থাৎ ধ্বংসের পর সেখানে আটবার সভ্যতা গড়ে উঠেছিল । হরপ্পায় ছ’টি স্তর আবিষ্কৃত হয়েছে । এই ছ’টি বা ন’টি স্তরের সর্বত্র মানুষের জীবনযাত্রা প্রণালী বা নগর পরিকল্পনা কিন্তু একই ধরনের — কোথাও কোনও পরিবর্তন ঘটে নি , তবে উপরের স্তরগুলিতে নগর কর্তৃপক্ষের অপদার্থতার ছাপ স্পষ্ট । দেখা যাচ্ছে যে , উপরের স্তরের ঘরবাড়িগুলি ক্রমশ রাস্তা দখল করছে , গলি ছোটো হয়ে আসছে , নর্দমা বুজে আসছে । এ সত্ত্বেও , নগর পরিকল্পনা ও জীবনযাত্রার ধারা কিন্তু সর্বত্রই একই রকম ।
হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসের কারণ ঃ
আনুমানিক ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হরপ্পা সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । ধ্বংসের কারণ নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদের অন্ত নেই ।
( ১ ) অনেকে মনে করেন যে , পূর্বে সিন্ধু উপত্যকায় প্রচুর বৃষ্টিপাত হত এবং এই অঞ্চলটি ছিল জঙ্গলাকীর্ণ । কালক্রমে এই অঞ্চলে জলবায়ুর পরিবর্তন ঘটে এবং এর ফলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায় ও ভূগর্ভস্থ লবণ উপরে উঠে এসে স্থানটিকে মরুভূমিতে পরিণত করে ।
( ২ ) স্যার মর্টিমার হুইলার ও অনেকে মনে করেন যে , পোড়া ইটের প্রচুর ব্যবহার ও অন্যান্য কারণে এখানে ব্যাপকভাবে বৃক্ষচ্ছেদন শুরু হয় এবং অঞ্চলটি বনশূন্য হয়ে পড়ে । এর ফলে বৃষ্টিপাতের অভাবে এই অঞ্চলের কৃষিকার্য বিপর্যস্ত হয়ে যায় এবং জনসাধারণ স্থানত্যাগে বাধ্য হয় ।
( ৩ ) ডঃ এম . আর . সাহানী ও অন্যান্য অনেকে বলেন যে , বারংবার সিন্ধুনদের বন্যার ফলে সভ্যতাটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । মহেঞ্জোদারো নগরীটি যে একাধিকবার বন্যা কবলিত হয়েছিল এবং বন্যা প্রতিরোধের জন্য ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হয়েছিল । সে সম্পর্কে কোনও সন্দেহ নেই ।
( ৪ ) এই সভ্যতাটি ধ্বংসের জন্য ভূমিকম্প , অগ্নিকাণ্ড — এমনকী সিন্ধুনদের গতিপথ পরিবর্তনকেও দায়ী করা হয়েছে।
( ৫ ) এই সভ্যতার পতনের জন্য অনেকে আবার নগর কর্তৃপক্ষের অপদার্থতা ও নাগরিক আদর্শের অবনতির কথা বলেন । মহেঞ্জোদারোর নীচের স্তরে নগর পরিকল্পনা ও রক্ষণাবেক্ষণ যত সুন্দর , পরের স্তরগুলিতে তা নয় । উপরের স্তরগুলিতে দেখা যাচ্ছে যে , রাস্তা দখল করে বাড়ি তৈরি হচ্ছে , নর্দমা বুজে আসছে , গলির মধ্যে ইটের পাঁজা তৈরি হচ্ছে , কিন্তু এগুলির বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে না । এইভাবে ওই সভ্যতা ক্রমে ক্রমে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় ।
( ৬ ) বলা হয় যে , বিদেশি আর্যদের আক্রমণেই এই সভ্যতা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় । মহেগ্বোদারোতে প্রকাশ্য রাস্তায় , কুয়োর ধারে , বাড়ির মধ্যে পলায়নরত বহু মানুষের স্তূপীকৃত মৃতদেহ পাওয়া গেছে । এই মৃতদেহগুলি প্রকাশ্য স্থানে পড়ে আছে , কোনও সৎকার হয় নি এবং তাদের মাথার পিছনে ধারালো অস্ত্রের আঘাত । বলা হয় যে , বিদেশিদেরঅতর্কিত আক্রমণের ফলেই এই অবস্থা হয়েছে এবং দেবরাজ ইন্দ্রই এই সভ্যতার ধ্বংসকারী । ঋগ্বেদে তাঁকে ‘ পুরন্দর ’ বা ‘ দুর্গ - ধ্বংসকারী ’ বলা হয়েছে । বলা বাহুল্য , সিন্ধু সভ্যতা ধ্বংসের কোনও কারণই ত্রুটিমুক্ত নয় । আপাতত মনে করা যেতে পারে যে , আর্য আক্রমণই সিন্ধু সভ্যতার ধ্বংসের কারণ — যদিও সকলে এ সম্পর্কে একমত নন ।
0 Comments